রির্পোটঃসিদ্দিকুর রহমান.
দেশের দক্ষিণাঞ্চল মৃৎশিল্পীদের অন্যতম স্থান। নানা প্রতিকূল ও কালের ব্যবধানে হারিয়ে যাচ্ছে এক সময়ের জনপ্রিয় শিল্পকর্ম মৃৎশিল্প। বদলে যাচ্ছে ওই সকল মৃৎশিল্পীদের পেশা। এক সময় মাটির তৈরি জিনিস পত্রাদি ছিল বাঙালিয়ানদের একমাত্র ঐতিহ্য। বিজ্ঞানের প্রসার ও আধুনিক কলকারখানা মৃৎশিল্পীদের জীবন ধারনের প্রক্রিয়াকে যেন স্থবির করে দিয়েছে। অ্যালুমিনিয়াম ও প্লাস্টিকের তৈরি আকর্ষনীয় জিনিস পত্রের কারণে মাটির তৈরি জিনিসপত্রের চাহিদা প্রায় ৯৮ ভাগই কমে গেছে। দেশে গ্রামীন জীবন যাতায় মাটির তৈরি জিনিস পত্রাদী দেখা গেলেও শহরে সমাজে তেমনটা দেখা যায় না। জীবনের তাগিদে খাদ্য আর জীবিকার প্রয়োজনে কর্মের সন্ধ্যানে মানুষ যখন ব্যস্ত হয়ে উঠে তখন তাকে ঐতিহ্য ধরে রাখা সম্ভব হয় না। ঠিক তেমনটিই ঘটেছে দক্ষিণাঞ্চলের মৃৎশিল্পীদের ক্ষেত্রে। পূর্ব পুরুষদের কর্মের চিহ্ন ধরে রাখতে আজও সদা ব্যস্ত তারা।
তার পরেও বেঁচে থাকার সংগ্রামের এই সব মৃৎশিল্পীরা এখন পেশা বদলাতে বাধ্য হচ্ছে। বাকেরগঞ্জ উপজেলার নিয়ামতি ইউনিয়নের মহেশপুর রামনগর, ডালমায়া গ্রামগুলো ঘুরে এই চিত্রই ফুটে উঠেছে। জানাগেছে বর্তমানে যারা এই গ্রামগুলোতে বসবাস করছে তাদের পূর্ব প্রজন্ম এই মৃৎশিল্পের সাথে জড়িত ছিল। যার ফলে তাদেরকেও এই পেশাকে টিকিয়ে রাখতে হচ্ছে। কিন্তু মাটির তৈরি জিনিস পত্রাদি উৎপাদন করতে যে পরিমাণ তথ্য ব্যয় হচ্ছে। উৎপাদনকৃত পণ্য বিক্রি করে খরচ বাদ দিয়ে সামান্য লাভ হচ্ছে। যার ফলে ওই সামান্য লাভের অর্থ দিয়ে একটা পরিবারে সদস্যদের জীবন যাপন করতে কষ্ট সাধ্য হয়ে পড়ে। যার ফলে মৃৎশিল্প ছেড়ে অন্য পেশায় নিয়োজিত হচ্ছে। আবার কেউ কেউ কষ্ট করে কিছু অর্থ জমিয়ে বিদেশেও পাড়ি জমিয়েছেন। আধুনিক বিজ্ঞানের প্রযুক্তির চাপায় পিষ্ট হচ্ছে সেই কালের কিছু শিল্পী ও শিল্পকর্ম। তারই পথ ধরে ওই গ্রামগুলোতে দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা মৃৎশিল্পকর্ম আজ বিলুপ্তির পথে। কর্মহারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছে মৃৎশিল্পীরা। ওই গ্রাম গুলো সরেজমিনে ঘুরে আরও জানাগেছে পূর্বে ৩ শত ৬০টি পরিবার এই মৃৎশিল্পের সাথে জড়িত থাকলেও বর্তমানে তা কমে এসে দাড়িয়েছে ২ শত ৫০ পরিবারে। আবার যে পরিবারগুলো বর্তমানে এই পূর্বপুরুষদের কর্মটি ধরে রেখেছে তাদেরও দিন আনতে পান্তা ফুরায়। সংসারে ৫ বছর বয়সী সন্তান থেকে শুরু করে ৮০ বছরের বৃদ্ধ দাদি পর্যন্ত সারাদিন এ কাজে নিয়োজিত থাকে।
কারণ তাদের একমাত্র আয়ের উৎস এই মৃৎশিল্পী। পরিবারের সকল সদস্যরা যদি এই কাজটিতে সহায়তা না করে তাহলে এই পরিবারটির জীবিকা নির্বাহ বন্ধ হয়ে যাবে। তেমনটি জানালেন মহেশপুর গ্রামের বিমল চন্দ্র পাল (৩৫) জানান, দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে এই পেশার সাথে জড়িত আছি। আগে তার পূর্বপুুরুষরা করত। শিক্ষা দীক্ষা না থাকায় এই পেশায় নিয়োজিত থাকতে হচ্ছে। কারণ ১১ সদস্যর পরিবার টিকিয়ে রাখতে এটাই তার একমাত্র সম্বল। তাইতো পরিবারের ছোট মেয়েটিকেও এই কাজে নিয়োজিত করছেন। একই গ্রামের সুশীল পাল (৬৮) জানান, সারাবছর এই মাটির তৈরি তৈজসপত্রাদি তৈরি করা হয়। কিন্তু বর্ষার সময় কিছুদিন বন্ধ রাখা হয়। বাপ-দাদার ঐতিহ্য ধরে রাখার চেষ্টা করছি। এদিকে মহেশপুর গ্রামরে উষা রানী পাল (৮০) জানান, ছোট কাল থেকে এই কাজ করে আসছি। প্রথমত ছিল বাবার ঘর, পরবর্তীতে স্বামীর ঘরে এসে এই কাজ করতে হচ্ছে। আর এটাই তাদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনের পথ। যার ফলে ছেলে-বৌ, নাতি-নাতনিরাও এই কাজে সহায়তা করছে। কিন্তু তিনি নিঃশ^াস ছেড়ে বলেন, কতদিন আর এই রকম টেনে টুনে চলা যায়। একদিকে মানুষ এই শিল্প কর্ম থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। অন্যদিকে আয়ের পথ সরু হয়ে আসছে। তাইতো সেদিন আর বেশি দূরে নয়, যেদিন আধুনিকতায় ছোয়ায় এই শিল্পকর্মটি হারিয়ে যাবে। এদিকে বাকেরগঞ্জ উপজেলায় নিয়ামতি ইউনিয়নের মৃৎশিল্পের সাথে জড়িত স্বশিক্ষিত যুবক লিটন পাল জানালেন এই মৃৎশিল্পের কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। তিনি বলেন, প্লাষ্টিক ও এ্যালুনিয়ামের জিনিসপত্র বাজারে আসায় আমাদের মাটির তৈরি আসবাবপত্র তেমন একটা চলে না। বংশানুক্রমে এই কাজ করে বেঁচে আছি কোন রকমে। মাটির জিনিসপত্রের দাম কম ও চাহিদা না থাকায় প্রয়োজনীয় পুঁজির অভাবে মৃৎশিল্পটি বাঁচাতে হিমশিম খাচ্ছি। এ সময় তিনি জানান অনেক পরিবার ও শিল্পী এই পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন। মাটি সংগ্রহ, জ¦ালানী দ্রব্যের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন ও বিক্রয়ের সাথে মিল না থাকায় প্রতিনিয়ত ঋণের বোঝা বৃদ্ধি পায়। এ সময় তিনি আরও জানান, অনেক মৃৎশিল্পী মহাজনদের কাছ থেকে দাদন নেয়ার ফলে মাটির জিনিসপত্র কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। শুধু এই মহেশপুর, রামনগর, ডালমায়াই নয় বাকেরগঞ্জের কলসকাঠি গ্রামে এ পালদের বিস্তৃত রয়েছে।
কিন্তু তাদেরও একই অবস্থা বিদ্যমান। প্রতি হাজার মাটির তৈরি মালশা বিক্রি করছে ৮ হাজার টাকা, কয়েল বক্স পিচ প্রতি পনের টাকা, সড়া প্রতিপিচ সোয়া ৩ টাকা দরে এবং ফুলে টব ৩০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়াও মাটির ব্যাংক, জলবিড়া, ঝুড়ি সড়া, টালি, পটারী, বিভিন্ন পুতুল তৈরি করা হচ্ছে। এই গ্রাম থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে মাটির তৈরি জিনিসপত্র সরবরাহ করা হচ্ছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ স্থান হচ্ছে- পিরোজপুর, ঢাকা, চাঁদপুর, কুমিল্লাসহ অন্যান্য বিভাগ ও জেলাগুলো। লিটন পাল আরও বলেন, এই পালদের কোন সমবায় সমিতি না থাকার ফলে তাদের দুঃসময়ে সাহায্য করার মত এনজিও ও ঋণপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের ব্যাতিরেকেই কিছু থাকে ন্ াতিনি বলেন, মাটির তৈরির আসবাবপত্রের পাজাপুরে আয় হয় ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা কিন্তু এর পিছনে প্রায় ১৩ থেকে ১৪ হাজার টাকা খরচ হয় পোড়া পর্যন্ত। পরবর্তীতে যাতায়াত ভাড়াসহ অন্যান্য খরচের পর যা থাকে তা দিয়ে পরিবার পরিচালনা করা দুরূহ। তাই ২০০ বছরের পুরনো এই অঞ্চলের মৃৎশিল্প টিকিয়ে রাখার জন্য উপর মহলের কর্মকর্তাদের প্রতি আহবান জানান তিনি। এছাড়াও বর্তমান সরকারের সাহায্য সহযোগিতার ব্যাপারে তিনি জানান, সরকারের পক্ষ থেকে কিছু ভিজিএফ কার্ডের মাধ্যমে সহায়তা পেলেও তা অপ্রতুল। সে রকম কোন অর্থ সহায়তা পাওয়া যায় না। এদিকে মৃৎশিল্পীদের ব্যাপারে জেলা প্রশাসক ড. গাজী মোঃ সাইফুজ্জামান জানান, মৃৎশিল্পীদের সাথে বিভিন্ন সেমিনার করে তাদের শিল্পকর্ম জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে তুলে ধরার জন্য সচেতনতামূলক কাজ করা হচ্ছে। কিছুদিন আগে মৃৎশিল্পীদের নিয়ে সমাবেশ করা হয়েছে এছাড়াও ওই সকল শিল্পীদের দেয়া হয়েছে সম্মাননা। বর্তমান সরকারও এক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রণোদনা দিচ্ছে। এ সময় মৃৎশিল্পীদের আর্থিক সহায়তার বিষয়ে তিনি বলেন, সরকার দরিদ্র জনগোষ্ঠির জন্য সামাজিক নিরাপত্তামূলক যে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে তার আওতাভুক্ত এই মৃৎশিল্পীরা রয়েছে। এছাড়াও এই শিল্পের জনপ্রিয়তা তাদেরকেই বাঁচিয়ে রাখবে। বর্তমানে এ দেশের সাধারণ মানুষ মাটির শিল্পকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করতে শুরু করেছে। তাই আমরা যারা বর্তমান সমাজের খোঁজ খবর রাখি তারা নির্দিধায় বলতে পারি এই পেশা আজ বিলুপ্তির পথে। বর্তমানে এই পেশায় নিয়োজিত কর্মীরাই শেষ প্রজন্ম। যদি না তারা তাদের পূর্ব পুরুষদের জ্ঞানের সাথে নতুন জ্ঞানের সন্নিবেশ ঘটান, মৃৎশিল্প কর্ম বাজারজাত করণের নতুন আইডিয়াতে নজর না দেন তবে মৃৎশিল্পের ভবিষ্যত কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে। তাই এই শিল্পকে বাঁচাতে হলে বর্তমান তথ্য প্রযুক্তির যুগে নিত্য নতুন টেকনোলজি এই সব জাত শিল্পীদের হাতে তুলে দিতে হবে। এতে করে আমাদের ঐতিহ্য রক্ষার পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের দরজাও খুলে যেতে পারে।