মর্যাদায় প্রত্যাবাসনের আকুতি নিয়ে কাঁদলেন রোহিঙ্গারা

0
359

Sharing is caring!

গত বছরের কোরবানির সময়টা প্রাণ বাঁচাতে কেটেছে বন-জঙ্গল, পাহাড়, ধানক্ষেত ও নদী সাঁতরিয়ে। কোনোমতে সীমান্তের জিরো পয়েন্টে এসে জড়ো হয়ে করা হয় আশ্রয়ের আকুতি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দারিদ্রতার মাঝেও লাখো বিপদাপন্নকে টেনে নেন বুকে। এর মাঝে কেটে গেছে একটি বছর।

- Advertisement -

বুধবার এশিয়ার বিভিন্ন দেশে পালিত হলো মুসলমানদের দ্বিতীয় প্রধান ধর্মীয় উৎসব কোরবানির ঈদ। নিজ দেশের বাইরে প্রথমবারের মতো কোরবানির ঈদ কেটেছে উখিয়া-টেকনাফে আশ্রিত ৩০ ক্যাম্পের প্রায় আট লাখ নতুন আসা রোহিঙ্গার। তাদের সাথে পুরনো সোয়া তিন লাখ রোহিঙ্গা মিলে ১১ লাখ ১৬ হাজার ৪১৭ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঈদুল আজহার নামাজ আদায় করেছে।

নিজ দেশে মধ্যযুগীয় বর্বরতার শিকার রোহিঙ্গারা বুধবার শরণার্থী শিবিরের এক হাজার ২৬৫ মসজিদ ও ৫৬০টি মক্তবে ঈদের নামাজ আদায়ের পর চোখের জলে হারানো স্বজনদের স্মরণ করেছেন। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঈদের নামাজ আদায়ের পর কান্নায় ভেঙে পড়েন ইমাম ও মুসল্লিরা। মোনাজাতে অংশ নেয়া লাখো রোহিঙ্গা মর্যাদার সাথে নিরাপদ প্রত্যাবাসন কামনা করে স্রষ্টার দরবারে ফরিয়াদ করেন।

গত বছর এই দিনে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপরে দেশটির সেনাবাহিনী বর্বর নির্যাতন চালায়। ফলে প্রাণ বাঁচাতে রোহিঙ্গারা নিজেদের আবাসস্থল ছেড়ে পালাতে থাকেন। এভাবে পালাতে গিয়ে অনেকে হারিয়েছেন বাবা-মা ও কাছের স্বজন। অনেক নারী হয়েছেন ধর্ষণের শিকার। সর্বস্ব হারানো এসব রোহিঙ্গাদের ঠাঁই হয়েছে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের পাহাড়ি অঞ্চলে।

উখিয়ার মধুরছরা ক্যাম্পের ডাবল ‘ও’ ব্লকের মাঝি সালামত খান বলেন, মিয়ানমারে আমাদের গোয়ালভরা গরু ছিল। প্রতি বছর আমরা একটা গরু কোরবানি দিয়ে প্রতিবেশীদের সাথে শেয়ার করতাম। কিন্তু এবার নিজের বাপ-দাদার ভিটাতেই অবস্থান নেই। ভিনদেশে প্রাণটা নিয়ে কোনোমতে বেঁচে আছি। মিয়ানমারের আগ্রাসনে বাবা-মাসহ অনেককে হারিয়েছি, আজ তাদের বেশি মনে পড়ছে।

পাশের আরেক ক্যাম্পের রোহিঙ্গা মাঝি রহমত উল্লাহ বলেন, গত বছর কোরবানির ঈদের নামাজ আদায় করতে পারিনি। আজকের এই দিনে আমরা ছিলাম রাখাইনের একটি পাহাড়ি জঙ্গলে। এবার বাংলাদেশে অন্তত ভালো করে ঈদের নামাজটি আদায় করতে পেরেছি।

উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মাঝি লাল মোহাম্মদ বলেন, আরাকানে আমরা পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশত্যাগ করলেও স্বজনদের কবর ও বাপ-দাদার ভিটামাটির জন্য মন কান্দে। মর্যাদার সাথে নিরাপদ প্রত্যাবসন হলে আমরা ফিরে যেতে চাই। এটিই ঈদ জামাত শেষে মোনাজাতে আল্লাহর কাছে বলেছি। এখানে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকলেও আশ্রিত জীবন আনন্দহীন।

উখিয়ার রাজাপালং ইউপির কুতুপালং এলাকার সদস্য বখতিয়ার আহমদের ছেলে হেলাল উদ্দিন বলেন, ঈদের নামাজ শেষে ইমাম যখন আরাকানে মাটির নিচে ফেলে আসা স্বজনদের মাগফিরাত কামনা করে দোয়া শুরু করেন তখন মসজিদে উপস্থিত সববয়সী রোহিঙ্গা চোখের জলে বুক ভাসান। মোনাজাতে বিপদাপন্ন সময়ে আশ্রয় দেয়ায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দীর্ঘায়ু ও বাংলাদেশের সমৃদ্ধি এবং নিরাপদ প্রত্যাবাসন কামনা করা হয়।

তিনি আরও জানান, বয়োবৃদ্ধরা মনোকষ্ট নিয়ে থাকলেও ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য বিগত বারের মতো আনন্দঘন পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা চালানো হয়। নাগরদোলা, রকমারি পণ্যের পসরা সাজিয়ে বৈশাখী মেলার আদলে আয়োজন করে স্থানীয় কিছু মানুষ। নতুন জামা পরে সেখানে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আনন্দে মত্ত ছিল শিশু-কিশোররা।

উখিয়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নিকারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা ১১ লাখ ১৬ হাজার ৪১৭ জন। এদের সিংহভাগ উখিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্পে অবস্থান করছে। নতুন আসা প্রায় আট লাখ রোহিঙ্গার দেশের বাইরে এটাই প্রথম ঈদ। স্বাভাবিভাবে এ দিনে কোরবানির পশুর মাংস না পেলে সবার খারাপ লাগে। আমরা চেষ্টা করেছিলাম রোহিঙ্গা সব পরিবারে অন্তত দুই কেজি করে মাংস দেব। এনজিও’রা কথা দিয়েও শেষতক তা রাখেনি। ফলে আমরা সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারিনি।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, কক্সবাজারের ৩০টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থিত এক হাজার ২০টি মসজিদ ও ৫৪০টি নুরানি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (মক্তক) ও টেকনাফের নিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাঁচটি, অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ২৪৫টি মসজিদ ও ২০টি নুরানি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (মক্তব) রয়েছে। এসব মসজিদ ও নুরানি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঈদের জামাত আদায় করেছেন শরণার্থী রোহিঙ্গারা।

উল্লেখ্য, গত বছরের ২৪ আগস্ট রাতে মিয়ানমারের রাখাইনে সহিংস ঘটনায় কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রয়ের জন্য পালিয়ে আসে প্রায় আট লাখ রোহিঙ্গা। এর আগে বাংলাদেশে অবস্থান করছিল আরও প্রায় সোয়া তিন লাখ রোহিঙ্গা। এরাসহ এখন ১১ লাখ ১৬ হাজার ৪১৭ জন রোহিঙ্গা আশ্রিত রয়েছে বাংলাদেশে। যুগের পর যুগ বংশ পরম্পরায় তারা রাখাইনে বাস করলেও মিয়ানমার তাদের নাগরিক বলে স্বীকার করে না।

উগ্র বৌদ্ধবাদকে ব্যবহার করে সেখানকার সেনাবাহিনী ইতিহাসের বাঁকেবাঁকে সাম্প্রদায়িক অবিশ্বাসের বীজ বপন করেছে, ছড়িয়েছে বিদ্বেষ। ১৯৮২ সালে প্রণীত নাগরিকত্ব আইনে পরিচয়হীনতায় ভোগে রোহিঙ্গারা। এরপর কখনও মলিন হয়ে যাওয়া কোনো নিবন্ধনপত্র, কখনও নীলচে রঙের রশিদ, কখনও ভোটার স্বীকৃতির হোয়াইট কার্ড, কখনও আবার ‘ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড’ কিংবা এনভিসি নামের রং-বেরংয়ের পরিচয়পত্র দেয়া হয়েছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে। ধাপে ধাপে মিয়ে গেছে তাদের পরিচয়। এভাবে তারা রূপান্তরিত হয়েছে রাষ্ট্রহীন নাগরিকে। তাই মর্যাদার সাথে নিরাপদ প্রত্যাবাসনের আশায় রয়েছে এসব নিপীড়িত মানুষ।

(Visited 2 times, 1 visits today)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here