বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের সংস্কৃতি গড়ে না ওঠায় শ্রমিকদের পক্ষ হয়ে কথা বলার কেউ ছিল না। এ কারণে বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকরা বছরের পর বছর ধরে কম মজুরি পেয়ে আসছেন।
সম্প্রতি আনুষ্ঠিত আইএলও’র বার্ষিক অধিবেশনের কার্যবিবরণীতে এমন আলোচনা উঠে এসেছে। সরকারের ‘নো ইউনিয়ন’ নীতির সমালোচিত হয়েছে সেখানে।
আইএলও’র বার্ষিক অধিবেশনের কার্যবিবরণীতে বাংলাদেশের শ্রমিকপক্ষের বক্তব্যে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রতি বছর কয়েক’শ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি করে থাকে। তবু বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে একজন শ্রমিকের মজুরি সব মিলিয়ে মাসে ৬৭ ডলার। যা দিয়ে জীবন ধারণ করা অত্যন্ত কঠিন। এ খাতে নিম্ন মজুরির অন্যতম কারণ হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে এ শিল্পে ট্রেড ইউনিয়ন করতে না দেয়ার নীতি।
শ্রমিকদের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, একটি ট্রেড ইউনিয়নের নিবন্ধন পেতে কমপক্ষে ৬০ দিন সময় লাগে। আবার সদস্য সংগ্রহের শর্ত হিসেবে যে কারখানার ট্রেড ইউনিয়ন সেখানে কমপক্ষে ৩০ শতাংশ সদস্য থাকার কথা বলা হয়। যা বাস্তবসম্মত নয়।
আশুলিয়ার আন্দোলনের কথা উল্লেখ করে আইএলও’র বার্ষিক অধিবেশনে আশা প্রকাশ করা হয় যে, সেখানে বহিষ্কার হওয়া সকল শ্রমিককে কাজে ফিরিয়ে আনা হবে।
সাধারণ রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে শ্রমিকদের সংগঠিত হতে দেয়া হয় না। এ কারণে সরকারকে অবশ্যই আইন পরির্বতন করে শ্রমিকদের পক্ষ হয়ে তা সংশোধন করতে হবে।
শ্রমিকদের পক্ষ থেকে অধিবেশনে আরও উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশে ট্রেড ইউনিয়ন করার ক্ষেত্রে সুরক্ষার অভাব রয়েছে। রানা প্লাজার ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে সরকার ও মালিকপক্ষ শ্রম অধিকারের প্রতি সম্মান দেখিয়ে ট্রেড ইউনিয়ন করার সুযোগ দেবে এবং এক্ষেত্রে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখবে।
অধিবেশনে শ্রমিকের স্বার্থে তাদের সংগঠিত হতে দেয়া, শ্রম আইন সংশোধন করা, রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে শ্রমিকদের মৌলিক অধিকারের চর্চা নিশ্চিত করা এবং সেই সঙ্গে শ্রমিকরা যাতে স্বাধীনভাবে ট্রেড ইউনিয়নের নিবন্ধন করতে পারেন সে বিষয়ে সাসটেইনেবল কমপ্যাক্টের আওতায় সরকার আইএলও, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র ও শ্রমিকদের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
উপসংহারে আশা প্রকাশ করা হয়, পোশাক শিল্পের আরও উন্নতি হবে, সেই সঙ্গে লক্ষাধিক চাকরির সুযোগ তৈরি হবে। তবে এ চাকরি হতে হবে নীতিনৈতিকতা সম্বলিত ভালো কাজ। ন্যূনতম জীবন ধারণের মতো মজুরি শ্রমিকদের দেয়ার আহ্বান করা হয় অধিবেশন থেকে।
অধিবেশনে ২০১৮ সালের মধ্যে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সকল শর্ত পূরণে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বাংলাদেশ। বার্ষিক অধিবেশনে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, বাংলাদেশ শ্রম আইন পরিবর্তন এবং এর বিধি বাস্তবায়ন নিয়ে আইএলও’র প্রদত্ত শর্তসমূহ সংস্থাটিকে স্ট্যান্ডার্ড মেনে সংগঠন করার পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া হবে। একই সঙ্গে শ্রম আইনের নতুন খসড়া প্রস্তুতের কথা জানায় বাংলাদেশ। যা আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে প্রস্তুত করে আইএলও’র সঙ্গে পর্যালোচনা করা হবে।
বিষয়টি এখনও আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে উল্লেখ করে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আরও বলা হয়, আগস্টের মধ্যে এ বিষয়ে মতামত নিয়ে শ্রম আইন প্রস্তুত করা হবে। ২০১৮ সালের জুনে আইএলও’র বার্ষিক সম্মেলনের আগে তা বাস্তবায়ন করা হবে।
আইএলও’র শর্ত ছিল ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধনের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত ও সহজ করার। সে শর্ত তৎক্ষণাৎ বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দেয় বাংলাদেশ। বাংলাদেশ জানায়, এ বিষয়ে একটি স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর চলতি বছরের ১৭ মে প্রস্তুত করা হয়েছে। এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াধীন।
এছাড়া রেমিডিয়েশন কো-অর্ডিনেশন সেলকে পূর্ণভাবে চালু করার শর্ত ছিল আইএলও’র। তা চলতি বছর জুনের শেষ দিকে কার্যকর হবে বলে জানায় বাংলাদেশ। এছাড়া আইএলও’র শর্ত অনুযায়ী শ্রমিকদের বিরুদ্ধে অন্যায্য চর্চার সুষ্ঠু তদন্তের বিষয়টি আগস্টের মধ্যে জানানো কথা বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়।
২৬৯ শ্রমপরিদর্শক নিয়োগের বিষয়ে আইএলও’র শর্তে বাংলাদেশ জানায়, ২০১৮ সালের জুনের মধ্যে সকল পরিদর্শক নিয়োগ দেয়া হবে। বর্তমানে পরিদর্শক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে এবং আগামীতে আরও ১৬৯ পরিদর্শক নিয়োগ দেয়া হবে। নিয়োগ প্রক্রিয়াটি পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে হচ্ছে বলেও জানায় বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের কাছে কারখানা সংস্কার ফান্ডের বিষয়ে জানতে চেয়েছিল আইএলও। এর উত্তরে বাংলাদেশ জানায়, বিষয়টি ২০১৮ সালের মধ্যে আমলে নেয়া হবে। এক্ষেতে বাংলাদেশ সরকার বাজারের বাস্তবতা অনুযায়ী যা যা করা দরকার তা করবে বলে জানায়।
অ্যাকোর্ড ফাউন্ডেশনের সঙ্গে কাজ করার বিষয়ে বাংলাদেশ জানায়, বিষয়টি নিয়ে তৈরি পোশাক মালিক সংগঠন বিজিএমইএ ও অ্যাকোর্ড আলোচনা করছে। এ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত আগামী নভেম্বরের মধ্যে জানা যাবে।
সূত্র জানায়, আইএলও’র শর্ত পালনের বিষয়টি ইতোমধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে বাংলাদেশ। সম্প্রতি এক চিঠিতে বাংলাদেশকে জিএসপি বাতিলের হুমকি দেয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন। শ্রম আইনের সংস্কার না হলে জিএসপি চলতি বছরের মধ্যে বাতিলের কথা বলা হয়। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ আইএলও’র বার্ষিক সম্মেলনে গিয়ে প্রদত্ত শর্তগুলো পরিপূর্ণ পালনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
প্রসঙ্গত, সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় ১০৬তম আন্তর্জাতিক শ্রম সম্মেলনে (আইএলসি) বাংলাদেশ বিষয়ক আলোচনা ১৪ জুন অনুষ্ঠিত হয়। এতে শ্রম অধিকার সংরক্ষণ ও আইএলও কনভেনশন বাস্তবায়নে কতটা অগ্রগতি হয়েছে, তা নিয়ে আলোচনা হয়।
সম্মেলনে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি বাংলাদেশের ৩৮ সদস্যবিশিষ্ট প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন।

















