প্রত্যাশা যৌক্তিক: রাজস্ব আদায়ে কঠোরতার ইঙ্গিত

0
160

Sharing is caring!

দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নে জোর দিয়ে একটি সমৃদ্ধিশালী দেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে দেওয়া অর্থমন্ত্রী হিসেবে তাঁর প্রথম বাজেটে তিনি শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতের উন্নয়ন, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে গুরুত্ব দিয়ে একটি দ্রুতবর্ধমান অর্থনীতির দিকে ধাবিত হওয়ার কথা তুলে ধরেছেন।

- Advertisement -

এজন্য তিনি শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে ব্যয় বাড়ানোর কথাই শুধু বলেননি, জাপানকে অনুকরণের বিষয়টি তুলে এনেছেন। তাঁর আশা, হয়তো জাপানের অগ্রগতির কৌশল রপ্ত করতে পারলে বাংলাদেশ একদিন বিশ্বদরবারে অন্যতম বৃহত্ অর্থনীতির দেশ হবে।

অর্থমন্ত্রীর স্বপ্ন অনেক। সমৃদ্ধ আগামীর পথযাত্রায় বাংলাদেশকে এগিয়ে যেতে তাঁর দৃঢ় প্রত্যয় রয়েছে। তিনি বলছেন, ‘সময় এখন আমাদের, সময় এখন বাংলাদেশের’। এমন উদ্দেশে তিনি নিয়েছেন কিছু পদক্ষেপ। এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করতে হলে অর্থের প্রয়োজন। সেই অর্থের সংস্থান করতে তিনি রাজস্ব আদায় বাড়ানোর দিকে জোর দিয়েছেন। এমনকি রাজস্ব আদায়ে কঠোর হওয়ার ইঙ্গিতও রয়েছে তাঁর বাজেট বক্তৃতায়। একই সঙ্গে তিনি সহনীয়ভাবে ও প্রযুক্তির সমন্বয়ে রাজস্ব প্রশাসনকে ঢেলে সাজানোর কথাও বলেছেন। যেমনটি তিনি তাঁর বাজেট বক্তৃতা উপস্থাপনের ক্ষেত্রে প্রযুক্তির সমন্বয়সাধন ঘটিয়েছেন।

অনন্য উপস্থাপনায় বাজেটকে তুলে ধরার বিষয়টিও ছিল প্রশংসনীয়। তবে শারীরিক অসুস্থতায় তিনি কিছুটা হোঁচট খেয়েছেন। স্পিকারের অনুমতি সাপেক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর বাজেট বক্তৃতার কিছু অংশ সংসদে পড়ে শোনান।

বিকেল ৩টায় সংসদ চালু হওয়ার আগে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে আগামী ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটকাঠামো অনুমোদিত হয়। মোট ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাবে অর্থমন্ত্রী সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী বৃদ্ধি, তরুণদের জন্য ১০০ কোটি টাকার তহবিল, মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বৃদ্ধি, সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালুসহ নানা প্রস্তাব করেছেন।

অপ্রদর্শিত অর্থ সাদা করার সুযোগ এবারে বিস্তৃত হয়েছে। তবে ব্যক্তি শ্রেণির করদাতার করমুক্ত আয়সীমা বৃদ্ধির দাবি থাকলেও তা বাড়াননি। জীবনযাত্রার ব্যয় মিটিয়ে এই সীমা ৫ লাখ টাকা হওয়ার সুপারিশ করেছিলেন অনেকেই। পাশাপাশি সঞ্চয়পত্রের মুনাফার কর দ্বিগুণ করেছেন। মোবাইলে কথা বলা ও ইন্টারনেট ব্যবহারে সম্পূরক শুল্ক দ্বিগুণ করা হয়েছে। এতে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীদের ব্যয় বাড়বে। মোবাইল কোম্পানির ন্যূনতম কর বাড়ানো হয়েছে। সব ধরনের রপ্তানি কর বাড়ানো হয়েছে ৪ গুণ। ৫০ কোটি টাকার সম্পদের ওপর সারচার্জ আরোপ করা হয়েছে। এভাবে অন্যান্য খাতেও কর বাড়িয়ে তিনি রাজস্ব বাবদ মোট ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্য স্থির করেছেন। তার প্রস্তাবিত ব্যয় বরাদ্দ মেটাতে রাজস্ব আদায়ে বিভিন্নমুখী পদক্ষেপ নিয়েছেন। পর্যায়ক্রমে কারদাতার সংখ্যা বৃদ্ধিসহ আয়কর খাতে এনবিআরের মোট আদায় ৫০ ভাগ নিশ্চিত করার কথাও বলেছেন তিনি। যদিও সরকারি প্রকল্পের ভ্যাট বাদ দিলে আয়কর থেকে এখনো বেশি আদায় হয়ে থাকে।

এবারে গ্রামাঞ্চলেও আয়কর কর্মকর্তারা হানা দেবেন, এমন আভাসও রয়েছে। দেশীয় শিল্পে বিশেষত হালকা মাঝারি শিল্পে কিছুটা সুবিধা দেওয়া হয়েছে। কৃষি, তৈরি পোশাকসহ কিছু খাত পাচ্ছে প্রণোদন। তবে দেশকে ভারী শিল্পসমৃদ্ধ করার মাধ্যমে কর্মসংস্থান বাড়াতে তেমন কোনো ঘোষণা আসেনি।

যদিও অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ২০৩০ সালের মধ্যে ৩ কোটি বেকারের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা হবে। বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী দেশের চাহিদার বিষয়টি অনুধাবন করেছেন, সে আলোকে কিছু কর্মপরিকল্পনাও দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় যথারীতি আছেই। তিনি বৈদেশিক উত্স থেকে বড় অঙ্কের ঋণ নেওয়ার কথাও বলেছেন। একইভাবে অভ্যন্তরীণ উত্স থেকেও ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য স্থির করেছেন। শেষ পর্যন্ত তার সমন্বয় ঘটাতে না পারলে বছর শেষে সংশোধনের বিকল্প নেই। তবে কোন খাতে, কীভাবে তা স্পষ্ট নেই।

গ্রামকে শহর করার স্বপ্নও দেখিয়েছেন তিনি। কিন্তু সেজন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠোমো উন্নয়নের বিষয়টি সুস্পষ্ট নয়। তবে প্রত্যাশা, এই বাজেট বাস্তবায়ন হোক এবং তা হলে দেশ দ্রুতই ডাবলডিজিট প্রবৃদ্ধিতে পৌঁছবে— এতে কোনো সন্দেহ নেই।

প্রস্তাবিত বাজেটে মোট আয়

আসছে অর্থবছরে মোট রাজস্ব আয় ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা ধরা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে এটি ছিল ৩ লাখ ৩৯ হাজার ২৮০ কোটি টাকা এবং সংশোধিত বাজেটে ছিল ৩ লাখ ১৬ হাজার ৬১২ কোটি টাকা। রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) অধীন আয় ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এনবিআর-বহির্ভূত কর ব্যবস্থা থেকে ১৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এছাড়া সরকারের বিভিন্ন সেবার ফি, হাসপাতালের টিকিট মূল্য, সেতুর টোলসহ বিভিন্ন খাত থেকে ৩৭ হাজার ৭১০ কোটি টাকা আদায়ের পরিকল্পনা রয়েছে।

ব্যয়ের খাত

প্রস্তাবিত ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটের আকার চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের মূল বাজেটের তুলনায় ৫৮ হাজার ৬১৭ কোটি টাকা বেশি। প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক অবকাঠামো খাতে বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে ১ লাখ ৪৩ হাজার ৪২৯ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ২৭.৪১ শতাংশ। এর মধ্যে মানবসম্পদ খাতে (শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য খাত) বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে ১ লাখ ২৯ হাজার ৫৬ কোট টাকা। ভৌত অবকাঠামো খাতে প্রস্তাব করা হয়েছে ১ লাখ ৬৪ হাজার ৬০৩ কোটি টাকা বা ৩১.৪৬ শতাংশ, যার মধ্যে সার্বিক কৃষি ও পল্লি উন্নয়ন খাতে ৬৬ হাজার ২৩৪ কোটি টাকা, বৃহত্তর যোগাযোগ খাতে ৬১ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা এবং বিদ্যুত্ ও জ্বালানি খাতে ২৮ হাজার ৫১ কোটি টাকা। সাধারণ সেবা খাতে প্রস্তাব করা হয়েছে ১ লাখ ২৩ হাজার ৬৪১ কোটি টাকা যা মোট বরাদ্দের ২৩.৬৩ শতাংশ। সরকারি বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি), বিভিন্ন শিল্পে আর্থিক সহায়তা, ভর্তুকি, রাষ্ট্রায়ত্ত, বাণিজ্যিক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগের জন্য ব্যয় বাবদ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে ৩৩ হাজার ২০২ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ৬ দশমিক ৩৫ শতাংশ। সুদ পরিশোধ বাবদ প্রস্তাব করা হয়েছে ৫৭ হাজার ৭০ কোটি টাকা যা মোট বরাদ্দের ১০.৯১ শতাংশ। নিট ঋণদান ও অন্যান্য ব্যয় খাতে প্রস্তাব করা হয়েছে ১ হাজার ২৪৫ কোট টাকা, যা মোট বরাদ্দের ০.২৪ শতাংশ।

ঘাটতি

প্রস্তাবিত বাজেটে মোট ঘাটতি ১ লাখ ৪৫ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা। এই ঘাটতি মেটাতে সরকারকে দেশি ও বিদেশি উত্স থেকে ১ লাখ ৪১ হাজার ২১২ কোটি টাকা ঋণ নিতে হবে। ঋণের অর্থের এই পরিমাণ বিদায়ি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের ঋণের চেয়ে প্রায় ১৬ শতাংশ বেশি। এবার বৈদেশিক উত্স থেকে ৭৫ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। সেখান থেকে ১১ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা আগের ঋণের কিস্তি পরিশোধে খরচ হবে। ফলে সরকারের নিট বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ৬৩ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকা। ঘাটতির বাকি ৭৭ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা নেওয়া হবে অভ্যন্তরীণ উত্স থেকে। এর মধ্যে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া হবে ৪৮ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা, সঞ্চয়পত্র থেকে নেয়া হবে ২৭ হাজার কোটি টাকা। বাকি তিন হাজার কোটি টাকা অন্যান্য উত্স থেকে।

সম্পূরক বাজেট:

বাজেট উপস্থাপনার শুরুতে চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের সম্পূরক বাজেট উপস্থাপন করা হয়। অর্থমন্ত্রী উল্লেখ করেন, চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের রাজস্ব আহরণ ও ব্যয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হলেও রাজস্ব আয় প্রত্যাশার চেয়ে কিছুটা কম হবে। চলতি অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত আহরিত রাজস্বের পরিমাণ ছিল লক্ষ্যমাত্রার ৫৪ দশমিক ৯ শতাংশ। একই সময়ে সরকারি ব্যয় হয় বার্ষিক বরাদ্দের ৪৪.৪ শতাংশ। সংশোধিত রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৩ লাখ ১৬ হাজার ৬১২ কোটি টাকা। মূল লক্ষ্য ছিল ৩ লাখ ৩৯ হাজার ২৮০ কোটি টাকা। অর্থাত্ মূল লক্ষ্যের চেয়ে ২২ হাজার ৬৬৮ কোটি টাকা কমানো হয়েছে।

চলতি অর্থবছরের বাজেটে সর্বমোট সরকারি ব্যয়ের প্রাক্কলন করা হয় ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে এ ব্যয় ২২ হাজার ৩২ কোটি টাকা হ্রাস করে ৪ লাখ ৪২ হাজার ৫৪১ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আকার ১ লাখ ৭৩ হাজার কোটি টাকা হতে ৬ হাজার কোটি টাকা হ্রাস করে ১ লাখ ৬৭ হাজার কোটি টাকায় নির্ধারণ করা হয়েছে। অন্যদিকে পরিচালনসহ অন্যান্য ব্যয়ের প্রাক্কলন হ্রাস করা হয়েছে ১৬ হাজার ৩২ কোটি টাকা।

সংশোধিত বাজেটে ঘাটতি অর্থায়ন:

চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাজেটে ঘাটতি প্রাক্কলন করা হয়েছিল ১ লাখ ২৫ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে ঘাটতি নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার ৯২৯ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫ শতাংশ। মূল বাজেটে ঘাটতির বিপরীতে বৈদেশিক উত্স হতে অর্থায়নের প্রাক্কলন ছিল ৫৪ হাজার ৬৭ কোটি টাকা যা সংশোধিত বাজেটে হ্রাস পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৪৭ হাজার ১৮৪ কোটি টাকায়। অভ্যন্তরীণ উেসর মধ্যে সঞ্চয়পত্র ও অন্যান্য সূত্র হতে অর্থায়ণের পরিমাণ ধরা হয়েছে ৪৭ হাজার ৮৫০ কোটি টাকা।

(Visited 1 times, 1 visits today)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here