মুকুল দাঃ কখনো ঝর্ণার মতো চঞ্চল কখনো আবার মুকুলোত্তর অর্ঘ্যসম প্রস্ফুটিত ফুল।।

0
700
মুকুল দাঃ কখনো ঝর্ণার মতো চঞ্চল কখনো আবার মুকুলোত্তর অর্ঘ্যসম প্রস্ফুটিত ফুল।।
মুকুল দাঃ কখনো ঝর্ণার মতো চঞ্চল কখনো আবার মুকুলোত্তর অর্ঘ্যসম প্রস্ফুটিত ফুল।।

Sharing is caring!

সিদ্দিকুর রহমান ॥

বরিশালের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অতি পরিচিত মুখ মুকুল দা। একদিকে নাট্যাভিনেতা, সুরকার, সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব, লেখক সহ একাধিক পরিচয় গুনের প্রতিভাসিত নাম মুকুল দাস। সংস্কৃতির আসরে তার এই তুমুল জনপ্রিয়তা অনেক ক্ষেত্রেই ঢেকে ফেলে তার অন্যান্য পরিচয়। একাধারে রবীন্দ্র-সলিল সিনে গানে তিনি ঝর্ণার মতো চঞ্চল, অন্যদিকে সঞ্চালনা-রসালোচনা-সিরিয়াস সেমিনারে তিনি মুকুলোত্তর অর্ঘ্যসম প্রস্ফুটিত ফুল। দীর্ঘ ৬৮ বছরের জীবনের এই সময়েও তিনি ছোট বড় সবার সাথেই খুনসুটি ও প্রাণবন্ত আলোচনা করে থাকেন অকপটে। এমনকি বরিশালে অনুষ্ঠিত হওয়া এমন কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নেই, যেখানে তিনি অংশগ্রহণ করেন না। সংস্কৃতির টানেই সেখানে ছুটে যান তিনি। এছাড়াও সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সকল মহলের নেতৃবৃন্দের আমন্ত্রণে সারা দিয়ে যেকোন অনুষ্ঠানেই তার উপস্থিতি বেশ চোখে পড়ার মত।

- Advertisement -

শুধু সংস্কৃতিজন হিসেবেই নয়, দক্ষ শিক্ষক হিসেবে মুকুল দাসের সুনাম তারই ¯েœহধন্য শিক্ষার্থীদের মুখ থেকে প্রায়শই শোনা যায়। তিনি শিক্ষাঙ্গনে যেমন তার দক্ষতা ও জ্ঞান ছড়িয়ে দিয়েছেন তেমনি সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তার প্রতিভা বিকশিত করেছেন ব্যাপক হারে। অন্যদিকে নাটকে সুনিপূন অভিনয়ের ক্ষেত্রেও মুকুল দাস একটি অনবদ্য চরিত্র ।
জানা গেছে, উত্তাল ৬৯-এ হাটখোলা মিলন নাট্য সংঘের উদ্যোগে জ্যোতিপ্রকাশ রায় হিটলারের নির্দেশনায় প্রসাদ বিশ্বাসের “পাকা রাস্তা” এবং কল্যান মিত্রের “প্রদীপ শাখা” নাটকে অভিনয় করেন তিনি। ১৯৭০ সালে যুব সংঘের ব্যানারে চিত্রকর নাট্যজন বলহরি সাহার লেখা এবং নির্দেশনায় “বাসর থেকে আসরে ” নাটকে অভিনয় করেন। স্বাধীনতার পর পর যুব সংঘের ব্যানারে ডি.এল. রায় এর “শাজাহান” নাটকে অভিনয়, পরবর্তীতে ৭৭ সালে ঢাকায় আরণ্যক নাট্যদলের সাথে যুক্ত থেকে“ ওরা কদম আলী” নাটকে অভিনয়, পরে ঢাকা থেকে বরিশাল ফিরে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নিখিল সেনের আহবানে বরিশাল নাটকে নিয়মিত নাট্যচর্চায় মনোবিশেষ করেন তিনি। এরপরে নিখিল সেনের নির্দেশনায় “রাধা রমন ঘোষের “অথ:স্বর্গবিচিত্রা, মনোজ মিত্রের “সাজানো বাগান” এবং নরক গুলজার, রতন কুমার ঘোষের “পিতামহদের উদ্দেশ্য” নাটকে অভিনয় শৈলি দিয়ে সারস্বত মহলের নজর কাড়েন মুকুল দাস। তাছাড়া গণ শিল্পী সংস্থার পরিবেশনায় প্রয়াত আকবর হোসেনের নির্দেশনায় ইন্দু সাহার নাটক “একে চন্দ্র দুয়ে পক্ষ” তার অভিনয় জীবনে উজ্জল উদাহরন। এছাড়াও তার এই বর্ণাঢ্য জীবনে তিনি সলিল চৌধুরি, দেবব্রত বিশ্বাস, অরবিন্দু বিশ্বাস, ধীরেন বসু, দেবদুলাল বন্দোপাধ্যায়, সত্যেন সেন, রনেশ দাশ গুপ্ত, কলিম শরাফী, ওয়াহিদুল হক, সানজিদা খাতুন, রামেন্দু ও ফেরদৌসি মজুমদার, আসাদ চৌধুরি সহ অসংখ্য গুনী মানুষের সহচার্যও পেয়েছেন।
১৯৪৯ সালের ১০ জানুয়ারি বরিশালের দপ্তরখানা এলাকার এক সম্ভ্রান্ত ও সংস্কৃতিমনা পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন মুকুল দাস। তার মা সরজু দাস ছিলেন ভজন গানের শিল্পী। বাবা মনীন্দ্র কুমার দাস ছিলেন তৎকালীন কংগ্রেস সমর্থক এবং সমাজসেবক। মুকুল দাস ১৯৫৩ সালে প্রভাতি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে (বর্তমান উদয়ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়) ভর্তি হয়ে সেখান থেকে মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হন। পরে ১৯৬৫ সালে ব্রজমোহন কলেজে বাণিজ্য বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৭০ সালে স্নাতকোত্তীর্ণ হয়ে কিছুদিন মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বাংলায় শিক্ষকতা করেন। ওই বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে অধ্যয়নকালে জগন্নাথ হলের ওয়েস্ট হাউজের টিনশেডে অবস্থান নিয়েছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালের ৬ জানুয়ারি হল ত্যাগের নির্দেশ দিলে বরিশাল চলে আসেন মুকুল দাস। ঐ সময় স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে পাড়ায় পাড়ায় গণসংগীত ও প্রতিবাদী নাটকে অভিনয় করেন। যুবসংঘ করতে গিয়ে ২৫ মার্চ থেকে ২৫ এপ্রিল মেয়াদে মুক্ত বাংলাদেশে সাংবাদিক হিসেবে যোগ দেন। এখানে থাকাকালীন চরবাড়িয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক দীলিপ বসুর মাধ্যমে বাংলার শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। কিন্তু সেখানে বেশি দিন থাকা হয়নি তার। অগত্যা ভবঘুরে হয়ে ঢাকায় নাট্যজন মামুনুর রশীদের আরণ্যক নাট্যদলের সদস্য হিসেবে ১৯৭৭ সালে ব্রিটিশ কাউন্সিল মঞ্চে নিয়মিত অভিনয় করেন মুকুল দাস। একই সময় বংশাল রোডের দৈনিক সংবাদের শিল্প ও সংস্কৃতি পাতায় লেখালেখি এবং শাহবাগের ঢাকা রেডিওতে কেজুয়াল তবলাবাদক হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। পরবর্তীতে ১৯৮০ সালে আবারও ঢাকা ছেড়ে বরিশাল প্রত্যাগমন করেন। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নিখিল সেন এবং শিক্ষাবিদ বদিউর রহমানের আমন্ত্রণে বরিশাল উদীচীতে কোরাস গানে নেতৃত্ব দেন মুকুল দাস।

একই সঙ্গে তিনি বরিশাল নাটকে অভিনয় করেন। এসময় মহাবাজ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহ-প্রধান শিক্ষক তরুণ চন্দ্র একরকম জোর করেই ওই বিদ্যালয়ে বাংলার শিক্ষক হিসেবে মুকুল দাসকে আবারও নিয়োগপত্র দেন। প্রবীণ এই শিক্ষকের শিক্ষকতা জীবনে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির ব্যানারে শিক্ষক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। বেসরকারি শিক্ষকদের ন্যায্য প্রাপ্যতার দাবিতে ১৯৮৬ সালে বঙ্গভবনে স্মারকলিপি প্রদান কর্মসূচি, ১৯৯৪ সালে শিক্ষকদের সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি, ২০০১ সালে বরিশাল বোর্ড আন্দোলনসহ নানা আন্দোলন-সংগ্রামে তাঁর উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ ছিল। দীর্ঘ ৩০ বছর ওই বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে ২০০৯ সালের ৯ জানুয়ারি অবসর গ্রহণ করেন বরিশালের এই সংস্কৃতি ব্যক্তিত্ব মুকুল দাস। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়ও লেখালেখি করতেন। বরিশালের বিপ্লবী বাংলাদেশ, গণডাক, লোকবানী, দৈনিক পরিবর্তনসহ স্থানীয় দৈনিকের বাংলার বনের সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন বহুদিন। এছাড়াও মাসিক আনন্দ লিখনে তিনি নিয়মিত লেখছেন। অমৃত লাল দে সংগীত একাডেমির সংগীত বিভাগের শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। এদিকে বরিশালের এই সংস্কৃতিজনের ঝুলিতে সম্মাননার সংখ্যাও কম নয়।

বিভিন্ন সংগঠন থেকে পেয়েছেন বহু পদক এবং গুনীজন সম্মাননা। ১৯৯৯ সালে র্কীতনখোলা থিয়েটারের রবীন্দ্র-নজরুল-মুকুন্দ উৎসবে গুনীজন সম্মাননা, ২০০৫ সালে কাউখালী উত্তরায়ন খেলাঘর আসরের সম্মাননা, ২০০৬ সালে অমৃত লাল দে সঙ্গীত একাডেমীর সম্মাননা অমৃত পদক, ২০১৩ সালে বলহরি সাহা স্মৃতি সংসদের নাট্যজন সম্মাননা, ২০১৪ সালে ঢাকাস্থ বরিশালবাসী অনুরাগীবৃন্দের সম্মাননা “মুকুল সন্ধ্যা”, ২০১৫ সালে বরিশাল জেলা প্রশাসনের কবি জীবনানন্দ সম্মাননা স্মারক, বরিশাল সাংস্কৃতিক সংগঠন সমন্বয় পরিষদের শহীদ আলতাফ মাহমুদ স্মৃতি পদক, দৈনিক কালের কন্ঠের গুনী শিক্ষক সম্মাননা, বরিশাল রির্পোটাস ইউনিটির মহান স্বাধীনতা দিবস সম্মাননা এবং একই বছরে চারুকলার মৃৎশিল্পী সম্মেলন ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন মুকুল দাস। জীবনের প্রান্তিক সময়েও এসে তার স্মৃতিচর্চা বিস্ময়কর। সকলের প্রিয় মুকুল দা বর্তমানে নগরীর মাতৃমন্দির লেনের একটি ভাড়া বাড়িতে সস্ত্রীক সহ বসবাস করছেন।

(Visited 10 times, 1 visits today)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here