তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ পরিচালিত আউটসোর্সিং প্রকল্পের (লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট) মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে কিশোরগঞ্জের প্রশিক্ষণার্থীরা। ৫০ দিনের প্রশিক্ষণে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগও তুলেছে। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রশিক্ষণার্থীরা মানববন্ধন করেছে। তারা জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে (১৭ মে) প্রধানমন্ত্রী বরাবর একটি স্মারকলিপি দিয়েছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, প্রায় ১৮১ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৪ সালে দেশব্যাপী এ প্রকল্পটি শুরু হয়। এটি শেষ হবে এ বছরের জুনে। আত্মকর্মসংস্থান ও অনলাইনে আউটসোর্সিং বাড়ানোর লক্ষ্যে ফ্রিল্যান্সারদের প্রশিক্ষণ দেওয়াই ছিল প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য। কিশোরগঞ্জে এ প্রকল্প শুরু হয় গত জানুয়ারি থেকে। প্রকল্পটি কিশোরগঞ্জে বাস্তবায়ন করছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘ডিজিকন কনসোর্টিয়াম’। সাতটি ব্যাচে (২৫ জন করে ব্যাচ) ১৭৫ জনের প্রশিক্ষণ শেষ হয়েছে। দুটি ব্যাচ চলমান।
প্রশিক্ষণার্থীদের অভিযোগ, যাঁরা প্রশিক্ষণ দেন, তাঁদের দক্ষতা অত্যন্ত নিম্নমানের। কলেজের ছাত্রদের দিয়েও প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। অনেক প্রশিক্ষণার্থী আছেন যাঁরা প্রশিক্ষকের চেয়েও দক্ষ। যে কারণে প্রত্যাশিত মানের শিক্ষণ পাচ্ছে না তারা। অ্যাডভান্স (উচ্চ) পর্যায়ের পরিবর্তে বেসিক (প্রাথমিক) প্রশিক্ষক দিয়ে দায়সারাভাবে কোর্স শেষ হচ্ছে। প্রতিদিন প্রশিক্ষণার্থীদের জন্য টিফিন বাবদ একটি বরাদ্দ আছে। বাস্তবে কোনো টিফিন দেওয়া হচ্ছে না। ইন্টারনেট সুবিধা দেওয়ার কথা আয়োজকদের। অথচ, প্রতিদিন অতি উচ্চ দামে ইন্টারনেট প্যাকেজ কিনতে হচ্ছে প্রশিক্ষণার্থীদের। প্রতিটি ব্যাচে ল্যাপটপসহ কিছু উপকরণ দেওয়ার কথা। বাস্তবে কিছুই দেওয়া হয়নি। প্রশিক্ষণের ভেন্যু ব্যবহার বাবদ যে ভাড়া, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে তা দেওয়া হয়নি।
প্রশিক্ষণার্থীরা জানায়, ডিজিটাল মার্কেটিং, গ্রাফিকস ডিজাইন এবং ওয়েব ডিজাইন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। ৫০ দিনের কোর্সে শুক্রবার ছাড়া সপ্তাহে ছয় দিন ক্লাস নেওয়া হয়। জেলা শহরের এসভি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, জেলা স্মরণি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও হাসমত উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের ল্যাবগুলো ভেন্যু হিসেবে ব্যবহার করছে প্রতিষ্ঠানটি।
প্রশিক্ষণার্থী মো. মাহফুজ (২৫) জানান, তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে খণ্ডকালীন চাকরি করতেন। চাকরি ছেড়ে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থানের স্বপ্ন নিয়ে লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং প্রশিক্ষণে যোগ দেন। এ জন্য ল্যাপটপসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি কিনে বিনিয়োগ করেছেন অন্তত ৫০ হাজার টাকা। তিনি বলেন, ‘অনলাইনে আয় দূরে থাক, মৌলিক বিষয়গুলোই শিখতে পারিনি। ’
গ্রাফিকস ডিজাইনের প্রশিক্ষণার্থী আব্দুল্লাহ আল মনসুর ও মো. হাসানুর রহমান বলেন, ‘প্রথমে বলা হয়েছিল, প্রশিক্ষণের শেষ দিকে প্রত্যেকে অন্তত ২৫ ডলার আয় করার সক্ষমতা অর্জন করবে। কিন্তু আয় করা দূরে থাক, অনলাইনে আয়ের মৌলিক বিষয়গুলোও শিখতে পারিনি। ’
আরেক প্রশিক্ষণার্থী ভৈরবের সোহরাব জানান, আইটি ব্যবসা ছেড়ে কিশোরগঞ্জ শহরে বাসা ভাড়া নিয়ে গ্রাফিকস ডিজাইনে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। কিন্তু নিম্নমানের প্রশিক্ষণের কারণে তিনি অর্জন করতে পারেননি কিছুই। শুধু তারা নন, ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজের ছাত্রী শেখ মৌরি তানিয়া, গুরুদয়াল কলেজের ছাত্রী ফরহাদ জাহান অহনা ও নেত্রকোনার কেন্দুয়ার মোস্তাকিমের একই অবস্থা।
প্রশিক্ষণ দানকারী ডিজিকন কনসোর্টিয়ামের কিশোরগঞ্জের সমন্বয়ক আলী আকবর বলেন, ‘যেসব প্রশিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, আমরা তাঁদের বদলিয়ে নতুন প্রশিক্ষক এনেছি। ’ তিনি টিফিনের জন্য যে বরাদ্দ ছিল, তা দেওয়া হয়নি বলে স্বীকার করে বলেন, ‘প্রয়োজনে এ টাকা পরিশোধ করা হবে। ’ যারা ৫০ দিনের প্রশিক্ষণে কিছুই শিখতে পারেনি তাদের কী হবে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রয়োজনে তাদের আরো শেখানো হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত তারা অনলাইনে আয় করতে না পারবে ততক্ষণ তাদের পাশে আমরা আছি। ’ প্রশিক্ষণার্থীদের জন্য কী কী বরাদ্দ আছে, জানতে চাইলে তিনি কোনো কথা বলেননি।
কিশোরগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) গোলাম মোহাম্মদ ভূঁইয়া বলেন, ‘লার্নিং ও আর্নিং প্রশিক্ষণ দেখাশোনা বা তদারকির দায়িত্ব আমাদের দেওয়া হয়নি। আমাদের শুধু বলা হয়েছে সহযোগিতা করতে। আমরা তা করে যাচ্ছি। এটি কেন্দ্রীয়ভাবে তদারকি করা হয়। আমাদের যদি ওভাবে দায়িত্ব দেওয়া হতো, তাহলে এ সমস্যা হতো না। ’
লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের কর্মকর্তা ও উপসচিব মীর্জা আলী আশরাফ বলেন, ‘এগুলো দেখভাল করার দায়িত্ব জেলা প্রশাসকদের। যিনি সহযোগিতা করবেন, তিনি তদারকিও করবেন। সচিব এ বিষয়ে জেলা প্রশাসকদের ডিও লেটার দিয়েছেন। আমি পিডি (প্রকল্প পরিচালক) হিসেবে যোগদানের পরে জেলা প্রশাসকদের অনুরোধ জানিয়ে আবারও আলাদা চিঠি দিয়েছি। বারবার অনুরোধ করছি যেন প্রশিক্ষণটা ভালোভাবে তদারকি করা হয়। এর পরও উনারা যদি দায়িত্ব না নেন, তা হবে আমাদের জন্য কষ্টকর। আমরা চাই, এ প্রকল্প ভালোভাবে শেষ হোক। ’